লকার থেকে সম্পদ হারালে যে ক্ষতিপূরণ পাবেন

চট্টগ্রামে ইসলামী ব্যাংকের চকবাজার শাখার লকার থেকে এক গ্রাহকের ১৪৯ ভরি সোনার গহনা উধাও হওয়ার অভিযোগ ওঠার পর ব্যাংকের লকারে দামী জিনিসপত্র রাখা এবং সেটার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

৩ জুন রাতে এ ঘটনায় ব্যাংকের চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চকবাজার থানায় অভিযোগ করেছেন গ্রাহক রোকেয়া বারী।

প্রশ্ন উঠেছে মূল্যবান সম্পদ নিরাপদে রাখার জন্য ব্যাংকের লকার ব্যবহার করা হয়। গ্রাহকের লকার রাখার নিয়ম কি? লকার থেকে জিনিস উধাও এর মতো ঘটনা ঘটলে ক্ষতিপূরণ হিসেবেই বা কী পাবেন গ্রাহক?

ইসলামী ব্যাংকের চকবাজার শাখায় ২০০৬ সাল থেকে একটি লকার ব্যবহার করেন গ্রাহক রোকেয়া বারী। নিজের মেয়ে নাশিয়া মারজুকার সাথে যৌথভাবে লকারটির গ্রাহক তিনি। গত বুধবার গ্রাহক রোকেয়া বারী নিজের লকারে থাকা কিছু স্বর্ণের অলঙ্কার আনতে যান।

ঘটনার দিন লকারের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাকে লকার খুলে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন তিনি। ওই কর্মকর্তা তার চাবি দিয়ে লকার রুম খুলে রোকেয়া বারীর লকারের নম্বর জানতে চান। লকারের নম্বর জানার পরই ওই কর্মকর্তা তার লকারটি খোলা অবস্থায় রয়েছে বলে তাকে অবহিত করেন।

তিনি সেখানে গহনার বেশিরভাগ বক্স খালি পড়ে থাকতে দেখেন। শুধুমাত্র আনুমানিক ১০/১২ ভরি গহনা কিছু বক্সে থাকতে দেখা যায়। বাকি আনুমানিক ১৪৯ ভরি গহনা উধাও হয়ে গেছে।

রোকেয়া বারীর ছেলে ডা. রিয়াদ মোহাম্মদ মারজুক বলেন, “মায়ের সাথে সবসময় একজন অফিসার লকার রুমে ঢোকে। ওই অফিসারের কাছে একটি চাবি থাকে। আরেকটি চাবি থাকে আম্মার কাছে। গেট খুলে আম্মার লকার নম্বর জেনে নিয়ে বলে লকার তো খোলা। পরে আম্মা নিজে দেখে গয়নার সব বক্স খালি। অল্প কয়েকটাতে আনুমানিক ১০-১২ ভরি গহনা পড়ে রয়েছে।”

পরে সাথে সাথে ব্যাংকের ম্যানেজারসহ বাকি কর্মকর্তাদের বিষয়টি অবহিত করা হয়। কিন্তু প্রথমে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঘটনার দায় অস্বীকার করে বলে জানান মি. মারজুক। ওইদিনই পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।

পরদিন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আবার ভুক্তভোগীর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে। তারা জানায় এ ঘটনা তদন্তে ব্যাংকটি অভ্যন্তরীণ একটি কমিটি গঠন করেছে। সাত দিনের মধ্যে এ বিষয়ে তাদের অবহিত করা হবে।

এছাড়া ঘটনার দিন রাতে চকবাজার থানায় গেলে সাধারণ ডায়েরি না করে মামলা করতে পরামর্শ দেয় পুলিশ। পরে সোমবার রাতে এ ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়।

মি. মারজুক বলেন, “আমরা বুঝতে পারছিলাম না মামলা কোথায় করবো, থানায় না আদালতে। আমাদের আইনজীবী যে ধারায় মামলা করতে বলে সেটা দেখে ওসি বলেন এটা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আওতাভুক্ত। পরে আমাদের এজাহারটা জিডি হিসেবে নেন তিনি।”

এদিকে, চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওয়ালী উদ্দিন আকবর বলেন, “এটি ব্যাংকের বিষয়। অভিযোগটি দুর্নীতি দমন কমিশনের তফসিলভুক্ত হওয়ায় তা দুদকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে সকালে।”

ইসলামী ব্যাংকের চকবাজার শাখার ম্যানেজার এস এম শফিকুল মাওলা চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি গণমাধ্যমের সাথে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

এর আগে ঘটনার পরই মি. চৌধুরী গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, চুক্তিপত্র অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক রোকেয়া বারী মাঝারি লকারের হিসাব অনুযায়ী দুই লাখ টাকা ইন্স্যুরেন্স পাবেন। সে সময় তিনি ব্যাংকটির হেফাজতে থাকা অবস্থায় সোনা উধাও এর ঘটনাকে ‘মিথ্যা অভিযোগ’ বলে দাবি করেছেন।

তিনি জানান, চুক্তিপত্র অনুযায়ী ছোট, বড় ,মাঝারি লকারের জন্য যথাক্রমে এক লাখ, দুই লাখ এবং তিন লাখ টাকা কর্পোরেট ইন্স্যুরেন্স দেয়া হয়।

গ্রাহকরা ব্যাংকের লকার ভাড়া নেন মূলত মূল্যবান দলিল, কাগজপত্র, অলংকারসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংরক্ষণের জন্য। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকেরই রয়েছে এই লকার সেবা। 

লকার গ্রহণের ক্ষেত্রে কয়েকটি সাধারণ নিয়ম রয়েছে।

এগুলো হলো:

১. লকার সেবা নিতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে একটি চলতি বা সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে।

২. লকার এবং এতে সংরক্ষিত সম্পদের জন্য নিকটতম আত্মীয় যে কোনো ব্যক্তিকে মনোনীত করতে হবে।

৩. সেফ ডিপোজিট লকার সেবা গ্রহণকারী ব্যক্তির জন্য এই মনোনয়ন সুবিধা থাকবে।

৪. এ ধরনের লকারের একক অধিকারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ একজন ব্যক্তিকে মনোনীত করা যাবে।

৫. সাধারণত বার্ষিক হারে অ্যাকাউন্ট থেকে চার্জ কেটে নেয়া হয়।

৬. এ সেবা গ্রহণ করার সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সাথে একটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করা হয়। যাতে ওই লকারে কী কী রাখা যাবে তা উল্লেখ করা থাকে।

৭. লকারে কোনো ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য, নেশা জাতীয় দ্রব্য, টাকা পয়সা রাখা যাবে না বলে চুক্তিপত্রে উল্লেখ করা থাকে।

ব্যাংকগুলোতে বেশ কয়েক আকারের লকার সেবা দেয়া হয়। ছোট, বড়, মাঝারি বিভিন্ন আকার অনুযায়ী এর ভাড়া নির্ধারণ করা হয়।

বেশ কয়েকটি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, লকারের মূল ফটকের চাবি শুধু ব্যাংকের নির্ধারিত কর্মকর্তার কাছে থাকে। প্রতিটি লকার খোলার জন্য দুটি চাবির প্রয়োজন হয়। যার একটি গ্রাহক ও অপরটি ব্যাংকের নির্ধারিত কর্মকর্তার কাছে থাকে।

এমনকি গ্রাহকের কোনও মনোনীত প্রতিনিধিও লকার খুলতে পারেন না।

গ্রাহকের চাবি ছাড়া শুধু ব্যাংকে থাকা চাবি দিয়ে লকার খোলা সম্ভব নয়। একমাত্র গ্রাহক ছাড়া ব্যাংকের কারও লকারের মালামাল ও তার পরিমাণ সম্পর্কে জানার অবকাশ নেই।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকের নির্ধারিত কর্মকর্তার কাছে একটা ‘মাস্টার কি’ থাকে। যেটি সব লকারের জন্য প্রযোজ্য। ‘মাস্টার কি’ কি হোলে প্রবেশ করানোর পর গ্রাহক নিজের চাবি দিলে তখনই কেবলমাত্র গ্রাহকের লকারটি খুলবে। একই সাথে যখন গ্রাহক লকার খুলে নিজের কাজ করবেন তখন সেখানে তিনি ছাড়া কেউ থাকতে পারেন না।

সম্পদ উধাও হলে যে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে

বাংলাদেশে ব্যাংকের লকার থেকে মূল্যবান সম্পদ, স্বর্ণালঙ্কার উধাও হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। অথচ নিয়মানুযায়ী, ব্যাংক থেকে গ্রাহক যে লকার সেবাটি নেন সেটি অন্য কেউ খুলতে পারার কথা নয়।

‘ব্যাংক-কোম্পানি আইন ১৯৯১’- এ ব্যাংকের কার্যাবলীর একটি ধারায় গচ্ছিত বস্তুর নিরাপত্তার জন্য ভল্টের ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে।

এ আইনের কোথাও গচ্ছিত বস্তুর ক্ষতি সাধন হলে কী ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে সে কথা উল্লেখ করা হয়নি।

শুধুমাত্র যদি ব্যাংকটির অবসায়ন হয় সেক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমানত বীমা আইন কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে।

২০০৮ সালের জানুয়ারিতে ঢাকার ধানমন্ডির শুক্রাবাদে ব্র্যাক ব্যাংকের এক শাখার লকার ভেঙে সোনার গহনা লুটের ঘটনা ঘটে।

ওই বছরই জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের লকারের নিরাপত্তা জোরদারে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা কঠোরভাবে মেনে চলার চন্য একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে।

এতে বলা হয়েছে, যে সব ব্যাংকের শাখায় লকার রয়েছে সেখানে পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

তবে, গ্রাহককে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে কি না সে বিষয়টি কোথাও উল্লেখ করা হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের লকার গোপনীয় ভাণ্ডার। ফলে গ্রাহক কী রাখছেন সেটি ব্যাংকের কেউ জানতে পারবে না।

এমনকি গোপনীয় স্থান হিসেবে সিসি ক্যামেরাও রাখা হয় না। তবে, লকার রুমে প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে সিসি ক্যামেরা নিরাপত্তার জন্যই সাধারণত রাখা হয়। গ্রাহকের নিজের স্বার্থেই লকারের গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউর রহমান বলেন, “লকারে ভ্যালু অ্যাসাইন করা যায় না। এটা এমন একটা স্টোরেজ যেখানে গ্রাহক কী রাখবে সেটা ব্যাংক জানবে না। যেহেতু ভ্যালু অ্যাসাইন করা যায় না সেহেতু এখানে ক্ষতিপূরণের মাত্রা নির্ধারণ করা যায় না।”

এই কর্মকর্তা বলছেন, গ্রাহকরা এসব সীমাবদ্ধতা মেনেই লকার পরিচালনা করে থাকেন। কারণ এ ধরনের সেবার প্রকৃতিই এরকম।

কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকারের ক্ষেত্রে ব্যাংকের যে ইন্স্যুরেন্স করা থাকে সে ক্ষেত্রে খুব স্বল্প অর্থই সাধারণত ক্ষতিপূরণ হয়।

যদি এ ধরনের ঘটনায় ব্যাংকের কর্মকর্তা দোষী প্রমাণিত হয় তাহলে ব্যাংক বা ওই কর্মকর্তাকে দায় নিতে হয়।

তবে গোপনীয় স্থান হওয়ায় এবং ভেতরে সিসি ক্যামেরা না থাকার কারণে গ্রাহকের জন্য বিষয়টি প্রমাণ করাও খুব কঠিন বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।

লকার সংক্রান্ত ক্ষতিপূরণের জন্য বেশ কয়েকটি বিষয় আরো সুনির্দিষ্ট করে নীতিমালা করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।

সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, “ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ইন্স্যুরেন্স করার সময় যেসব বিষয় তাদের চুক্তিতে থাকে সেগুলোই শুধু কাভার করবে। ফলে যদি ব্যাংক কর্মকর্তা চুরি করে তাহলে ইন্স্যুরেন্স পলিসিতে রয়েছে কি না সেটা দেখতে হবে।”

“গ্রাহকের লকার সেবা গ্রহণের আরো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করা প্রয়োজন। অর্থাৎ গ্রাহক লকারে যা রাখবেন তা যেন তার চুক্তিতে উল্লেখ করা থাকে। গোপনীয়তা রক্ষা করবে ব্যাংক। তাহলে গ্রাহকের ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি সহজ হবে,” বলেন মি. করিম

সোর্সঃবিবিসি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *