ভায়াগ্রা আবিষ্কারের ইতিহাস

যৌনতার ইতিহাসে ভায়াগ্রার আবিষ্কারকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরা হয়, কিন্তু মজার বিষয় হল, এই ওষুধটি আবিষ্কার হয়েছিল দুর্ঘটনাবশত অন্য রোগের ওষুধের পরীক্ষার চালানোর সময়। যে ওষুধটির প্রয়োজনীয়তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ভায়াগ্রা ১৯৯৮ সালে বিক্রি শুরু হয় এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটি সবচেয়ে বেশি বিক্রীত ওষুধে পরিণত হয়।

ঘটনাক্রমে আমেরিকান ওষুধ কোম্পানি ফাইজারের আবিষ্কৃত এই ‘ব্লু পিল’ এখন তাদের বিশাল অর্থ উপার্জনের মেশিনে পরিণত হয়েছে।

ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার হতে পারেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ভায়াগ্রার ‘পোস্টার বয়’ হয়েছিলেন।

খ্রিস্টানদের আধ্যাত্মিক নেতা পোপও ভায়াগ্রার প্রতি তার সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছিলে

শিল্প শ্রমিকদের প্রচেষ্টায় ভায়াগ্রার আবিষ্কার

ভায়াগ্রার ইতিহাসের সাথে ব্রিটেনের সাউথ ওয়েলসের শিল্প শহর মার্থার টিডওয়েলের বড় ধরনের যোগসূত্র রয়েছে।

এই শহরের অনেক পুরুষই ইস্পাত কারখানার শ্রমিক ছিলেন। কিন্তু শিল্প মন্দার সময়, তারা কারখানা ছেড়ে অন্যত্র চাকরি খুঁজতে বাধ্য হন।

এই বেকার শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে কেউ কেউ স্থানীয় একটি মেডিকেল সেন্টারের গবেষণা কেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ নেন।

১৯৯০ এর দশকের গোঁড়ার দিকে, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ফাইজার সিলডেনাফিল ইউকে ৯০,৪৮০ নামক একটি উপাদান পরীক্ষা করছিল।

উদ্দেশ্য ছিল ওই উপাদান দিয়ে উচ্চ রক্তচাপ এবং এনজিনা বা বুকে ব্যথা নিরাময়ের ওষুধ তৈরি করা।

এজন্য কোম্পানিটি গবেষণা কেন্দ্রে গবেষণা চালায় এবং ওষুধটি পরীক্ষার জন্য শুধুমাত্র কিছু যুবক স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়োগ দেয়।করা হয়।

কিন্তু যখন এই ওষুধের পরীক্ষা শেষ হয়, তখন তাদের শরীরে এক অস্বাভাবিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এই পরীক্ষার সাথে জড়িত নার্সরাও পর্যবেক্ষণ করেন যে, ওষুধ গ্রহণকারীরা লিঙ্গের উত্থান স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হচ্ছে বলে তাদের জানিয়েছেন। তারা বলেন যে, “বিষয়টি কিছুটা বিব্রতকর, কিন্তু আমি লক্ষ্য করছি যে আমি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সতর্ক বোধ করছি এবং আমার যৌনাঙ্গের শক্তি আগের চেয়ে বেশি হয়ে গিয়েছে।”

 ড. পিটার৷ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরের সাউথমিড হাসপাতালে ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ শিথিলতায় ভোগা রোগীদের উপর ওষুধটি পরীক্ষা করা হয়। ব্রিটেনের সোয়ানসি সিটিতে ১৯৯৪ সালে আরো একটি ক্লিনিকাল ট্রায়াল পরিচালিত হয়। সোয়ানসির মোরেস্টন হাসপাতালে বড় পরিসরে ওষুধটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চলে। যেখানে এটি ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগীদের উপরও পরীক্ষা করা হয়। কেননা ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগে আক্রান্তরা তাদের ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ শিথিলতা আছে বলে অভিযোগ করেছেন।

এই ট্রায়ালের প্রধান এবং এন্ডোক্রিনোলজি বিশেষজ্ঞ ডেভিড প্রাইস বলেছেন, “ফাইজার জানিয়েছিল এই পরীক্ষা শুধুমাত্র যেসব পুরুষ শুধুমাত্র নারীদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন এবং যারা কোন নারীর সাথে সম্পর্কের মধ্যে আছেন তাদের উপর চালানো হয়েছিল। “আমরা ওষুধটি এমন সাধারণ পুরুষদের উপর পরীক্ষা করেছি। তারা মূলত সোয়ানসির ব্লু-কলার জব করা অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণীর বিবাহিত পুরুষ ছিলেন।” “ট্রায়াল চলাকালে ওই পুরুষদের অশ্লীল ভিডিও দেখানো হয়েছিল,” তিনি বলেন। ওষুধের প্রভাব পর্যবেক্ষণের জন্য ট্রায়ালে অংশ নেয়া পুরুষদের পুরুষাঙ্গে একটি ডিভাইস বসানো হয়। চিকিৎসকরা স্বেচ্ছাসেবকদের আশ্বস্ত করেছিলেন যারা ট্রায়ালে অংশ নিয়েছেন তাদের কোনও সমস্যা হবে না। ব্রিস্টল গবেষণার মতো সোয়ানসিতে চালানো একটি পরীক্ষায় ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যায়। ফাইজার বুঝতে পেরেছিল যে তাদের হাতে একটি সম্ভাব্য ‘গেম চেঞ্জার’ ওষুধ রয়েছে। যা এই শিল্পে বিপ্লব ঘটাবে।ওষুধ ফেরত দিতে অস্বীকৃতি ভায়াগ্রার দুর্ঘটনাজনিত আবিষ্কারের দিকে পরিচালিত প্রথম গবেষণাটি ১৯৯২ সালে করা হয়েছিল, কিন্তু সেই আবিষ্কারের পরে, ফাইজার আরও ২১টি পরীক্ষা পরিচালনা করে। “এই ট্রায়ালগুলো ইরেক্টাইল ডিসফাংশনে ভোগা রোগীদের ওপর চালানো হয় এবং প্রতিটি পরীক্ষায় ওষুধটি কাজ করে, যা আশ্চর্যজনক ছিল।”

এই পরীক্ষায় আরেকটি আশ্চর্যজনক বিষয় হল, সাধারণত ট্রায়ালের সময় যখন রোগীদের ওষুধ দেওয়া হয়, তারা অনেক সময় সেই ওষুধ খেতে ভুলে যেতেন।‌ তবে এই পরীক্ষায় এমন কোনও সমস্যা হয়নি। ওষুধের ফলাফল এতই ইতিবাচক ছিল যে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী অনেক পুরুষ স্বেচ্ছাসেবক তাদের অব্যবহৃত ওষুধগুলো ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানায়।ভায়াগ্রার ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলো এতটাই সফল হয়েছিল যে ফাইজার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটি বাজারে আনার সিদ্ধান্ত নেয়।

ছয় মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন-এফডিএ ওষুধটি বিক্রির অনুমোদন দেয়। এরপর ফাইজারের বিপণন দল তখন ভাবতে শুরু করে যে তারা কীভাবে সঠিকভাবে নতুন ওষুধের প্রচার করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা ভেবেছিলেন যে সাধারণ মানুষ একে ‘বিশেষ কিছু’ বা ‘বিপর্যয়কর’ ওষুধ বলে মনে করবে কিনা। ফাইজার তৎকালীন রক্ষণশীল বিশ্বে এমন ‘সেক্স ড্রাগ’ বা যৌনতার ওষুধ প্রবর্তন করার কথা ভেবে বেশ উদ্বিগ্ন ছিল।

তারা ক্লিনিকাল ট্রায়ালের সময় পুরুষদের একটি প্রতিক্রিয়াকে তাদের বিপণন বার্তায় রূপ দেয়।

 ফাইজার বলেছে যে, ‘ওষুধটি তাদের দুর্বল যৌন সম্পর্ক নিরাময় করতে পারে’। এমনকি তারা ভ্যাটিকান থেকেও সমর্থন পেয়েছিলেন, যারা বিশ্বাস করেছিল যে ভায়াগ্রা বিবাহ বন্ধনকে শক্তিশালী করতে পারে এবং পারিবারিক মূল্যবোধকে উন্নত করতে পারে।

উনিশশো আটানব্বই সালে, ব্যাপক প্রচারের পর ভায়াগ্রা যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের বাজারে ছাড়া হয়। ভায়াগ্রা প্রথম বাজারে আসে ‘ব্লু পিল’ নাম নিয়ে।ভায়াগ্রা হল ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ শিথিলতার চিকিৎসার জন্য ইতিহাসে প্রথম অনুমোদিত ওষুধ। এটি শীঘ্রই ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুত বিক্রি হওয়া ওষুধে পরিণত হয়। ২০০৮ সালে এর বার্ষিক বিক্রি প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। যা এক বছরে ওষুধ বিক্রির শীর্ষে ছিল।

অ্যাডার ছিলেন স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে একজন যারা ভায়াগ্রা আবিষ্কারে সহায়তা করেছিলেন। এই স্বেচ্ছাসেবকদের কারণে, লাখ লাখ মানুষ উপকৃত হয়েছে। কিন্তু তিনি যে ওষুধের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন সেটি যে এতো জনপ্রিয় হয়েছে সে সম্পর্কে অবগত ছিলেন না।

“আমি যখন এ সম্পর্কে জানতে পারি তখন আমি হতবাক হয়ে যাই” অ্যাডার বলেন। ”ভায়াগ্রা এখন একটা বড় বিষয় হয়ে গিয়েছে। আমি বেশ খুশি যে এটি আমাদের শহরে আবিষ্কার হয়েছে।”

ভায়াগ্রার সহ-প্রতিষ্ঠাতা ডা. ডেভিড ব্রাউন বলেন, সাউথ ওয়েলসের পুরুষ না থাকলে আজকের দিনে ভায়াগ্রার অস্তিত্বই থাকত না।“তারা ইতিহাস গড়েছে। তারা হয়তো কিছু বাড়তি উপার্জনের জন্য ওই ওষুধের পরীক্ষায় অংশ নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা মানুষের জীবনে বড় পরিবর্তন এনেছে। তাদের এই ভেবে ভাল বোধ করা উচিত,” তিনি বলেন।

ভায়াগ্রা কিভাবে কাজ করে?

পৃথিবীর ইতিহাসে পুরুষদের যৌন সমস্যা বেশ প্রাচীন সমস্যাগুলোর একটি। ঐতিহাসিকভাবে, পুরুষদের এই সমস্যাটির বিষয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক উল্লেখ পাওয়া যায় দুই হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের প্রাচীন মিশরীয় লেখায়।

তৎকালীন চিকিত্সকরা রোগীদের এই সমস্যা নিরাময়ে, একটি বাচ্চা কুমিরের হৃদপিণ্ড নিয়ে লিঙ্গে ম্যাসেজ করার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু ভায়াগ্রা আবিষ্কার এই সমস্যার একটি বৈপ্লবিক সমাধান দেয়।

মূলত, ভায়াগ্রা পুরুষের লিঙ্গে রক্ত প্রবাহ বাড়ায় এবং মস্তিষ্কে নাইট্রিক অক্সাইড নামক এক ধরনের রাসায়নিক বা নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসরণ করে, যা লিঙ্গের ধমনীতে প্রবাহিত হয় এবং সাইক্লিক জিএমপি নিঃসরণ ঘটায়।

“ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ শিথিলতায় আক্রান্তরা মূলত পর্যাপ্ত পরিমাণে সাইক্লিক জিএমপি তৈরি করতে পারে না এবং ভায়াগ্রা এই প্রক্রিয়াটি উন্নত করে।”

তিনি বলেন, ‘সাধারণত, ৫০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেটের ৭০% ফলাফল পাওয়া যায়, তবে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ক্ষেত্রে ফলাফল ৬০% পাওয়া যায়, যেখানে মূত্রাশয় অপসারণ করা রোগীদের ক্ষেত্রে ফলাফল ৪০% পর্যন্ত পাওয়া যায়।’

এর কারণ হল মূত্রাশয় অপসারণ করার সময়, সার্জন পুরুষাঙ্গের কয়েকটি শিরা কেটে ফেলে।ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থা এনএইচএস এর তথ্যমতে, ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ শিথিলতা একটি সাধারণ রোগ যা ৪০ বছর বা তার বেশি বয়সী পুরুষদের মধ্যে একটি সাধারণ বিষয়।

কিছু গবেষণা অনুসারে, ৪০ থেকে ৭০ বছর বয়সী প্রায় অর্ধেক পুরুষ এতে আক্রান্ত হয়। শুধু যুক্তরাজ্যে ৪০ লাখ পুরুষ এতে আক্রান্ত।

এক সমীক্ষা অনুসারে, ২০২৫ সালের মধ্যে, ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা লিঙ্গ শিথিলতায় আক্রান্ত পুরুষের সংখ্যা ৩২ কোটি ২০ লাখে দাঁড়াবে।

১৯৯৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, এই সংখ্যা ছিল ১৫ কোটি ২০ লাখের মতো, কিন্তু এখন এটি দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *