প্রায় একশ বৎসর আগে জর্জ স্টিফেনসন বাষ্পের জোরে গাড়ি চালিয়ে তাতে লোকের যাতায়াতের ব্যবস্থা করবার প্রস্তাব করেন।
তখন সে প্রস্তাবে এতরকম আপত্তি উঠেছিল যে, ক্রমে তর্কটা পার্লামেন্ট পর্যন্ত গড়ায়। শেষটায় অনেক ঝগড়াঝাটি গণ্ডগোলের পর, স্টিফেনসনকে নানারকম জেরা করে তারপর অনুমতি দেওয়া হল—”আচ্ছা, তোমার রেলগাড়িটা না হয় একবার পরীক্ষা করে দেখা যাক!” স্টিফেনসন সহজে জেদ ছাড়বার লোকে ছিলেন না—তাই তিনি শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে ছাড়েননি।
এই জর্জ স্টিফেনসনের জীবনের কথা অতি অদ্ভুত। নিতান্ত গরীবের ঘরে যার জন্ম, যে লেখাপড়ার কোনরকম সুযোগ পায়নি এবং ত্রিশ বৎসর বয়স পর্যন্ত কেবল কয়লার খনিতে সামান্য কাজ করেই জীবন কাটিয়েছে, তার মনে এমন আশ্চর্য শক্তি আসে কোথা হতে, ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়।
স্টিফেনসনেরা ছয় ভাইবোন। বাপ মা অত্যন্ত গরীব, কাজেই ছেলেবেলা থেকেই সব ক-টি ভাইকে টাকা উপর্জনের চেষ্টা করতে হত। তারা নানান কাজ করে একেকজন দিনে প্রায় দু আনা রোজগার করত। খনিতে নানারকম কল-কারখানা থাকে, সেইগুলার উপর জর্জের ভারি নজর ছিল। সুযোগ পেলেই সে সেগুলোকে নেড়েচেড়ে তার ভিতরের কলকব্জা খুলে দেখত।
বইটই কিছুমাত্র না পড়েও কেবল নিজে দেখেশুনে এ-সকল বিষয়ে তার আশ্চর্য দখল জন্মেছিল। সে সময়ে কয়লার খনিতে যে-সকল এঞ্জিন ব্যবহার হত তাদের ‘খাড়া এঞ্জিন’ বলা যায়—অর্থাৎ সে এঞ্জিন এক জায়গায় খাটান থাকে; তার চাকার সঙ্গে দড়ি, শিকল বা লোহার হাতল জুড়ে গাড়ি টানা, মোট বওয়া, জিনিসপত্র উঠান-নামান প্রভৃতি নানারকম কাজ চালান হয়। সেই সময় হতেই চাকায়-বসান চলন্ত এঞ্জিন গড়বার খেয়াল স্টিফেনসনের মাথায় চেপেছিল।
যাহোক ক্রমে স্টিফেনসনের অবস্থার উন্নতি হতে লাগল। ক্রমে তার সপ্তাহে ১২ শিলিং (নয় টাকা) মাইনে হল—তার উপর জুতা সেলাই করে আর ঘড়ি মেরামত করেও সে কিছু কিছু উপর্জন করতে লাগল। সকলে বলল, “জর্জ মস্ত রোজগেরে হয়েছে।” এইভাবে প্রায় ত্রিশ বৎসর কেটে গেল, এর মধ্যেই পাকা ইঞ্জিনিয়ার স্টিফেনসনের বেশ একটু নাম হয়েছে।
১৮১৪ খৃষ্টাব্দে ৩৩ বৎসর বয়সে এক খনির মালিককে রাজি করিয়ে স্টিফেনসন তাঁর প্রথম চলন্ত ইঞ্জিনের পরীক্ষা করেন। এই ইঞ্জিনের সঙ্গে কয়লার গাড়ি জুড়ে দেখা গেল যে ৫০০ মণ কয়লা উঁচু রাস্তায় ঘণ্টায় চার মাইল করে নেওয়া যায়। আগে ট্রামের লাইন বসিয়ে তার উপর লোকেরা গাড়ি ঠেলে নিত, সেই লাইনের উপরই ইঞ্জিন বসিয়ে কয়লা চালান হতে লাগল। তারপর বছর খানেকের মধ্যে আরো ভাল দুটি ইঞ্জিন তৈরি হল, ক্রমে আশেপাশে আরও কত কয়লার খনিতে স্টিফেনসনের ইঞ্জিন চলতে লাগল। এমনি করে আট-দশ বৎসর কেটে গেল।
তখন স্টকটন হতে ডার্লিংটন পর্যন্ত কয়েক মাইল ট্রামের লাইন বসিয়ে ঘোড়ার ট্রাম করবার কথা হচ্ছিল। স্টিফেনসন প্রস্তাব করলেন, ঐ লাইনের উপর ইঞ্জিনের গাড়ি চালান হোক। অনেক কথাবার্তা হাঁটাহাঁটির পর, ট্রামের কর্তারা রাজি হলেন।
১৮২৫ খৃষ্টাব্দে এই লাইন যেদিন খোলা হল তখন “স্টিফেনসনের লোহার ঘোড়া’ দেখবার জন্য ভিড় জমে গিয়েছিল। কয়লা আর ময়দায় বোঝাই হয়ে একগাড়ি যাত্রী নিয়ে স্টিফেনসনের ইঞ্জিন স্টকটন হতে রওনা হল; স্টিফেনসন নিজে তার ড্রাইভার।
গাড়ির আগে আগে কোম্পানির লোক ঘোড়ায় চড়ে নিশান নিয়ে ছুটল! কিন্তু স্টিফেনসন তাঁর ইঞ্জিনে পুরো দম দিয়ে এমন ছুটিয়ে দিলেন যে, সে লোকটির আর সঙ্গে যাওয়া হল না। ডার্লিংটনে সমস্ত মালপত্র নামিয়ে সমস্ত ট্রেনটিকে পঙ্গপালের মতো লোক-বোঝাই করে স্টিফেনসন স্টকটনে ফিরে এলেন। না জানি সে সময়ে লোকের মনে কিরকম উতসাহ হয়েছিল।
কিন্তু এতেও গোলমাল মিটল না। এরপর যখন ম্যানচেস্টার থেকে লিভারপুলের পর্যন্ত রেল করবার কথা হল, তখন আবার তুমুল ঝগড়া আরম্ভ হল।
রেলগাড়ি জিনিসটাতেই অনেকের আপত্তি। কেউ কেউ তাকে ‘শয়তানের যন্ত্র’ বলে গাল দিতেও ছাড়েনি। এর মধ্যে আবার অন্য কয়েকটি ইঞ্জিনওয়ালা এসে বললেন, “আমরা আরো ভাল ইঞ্জিন বানিয়েছি—আমাদের উপর ভার দাও।”
কেউ বললেন, “স্টিফেনসন আবার কোথাকার কে? নাম জানি না, ধাম জানি না—এত বড় কাজের ভার কি যার তার উপর দেওয়া যায়?” তখন চারিদিক থেকে পার্লামেন্টের কাছে দরখাস্ত যেতে লাগল। পার্লামেন্টের হুকুমে সব ইঞ্জিন এক জায়গায় এনে তার পরীক্ষা নেওয়া হল। পরীক্ষায় স্টিফেনসনের ইঞ্জিন আর সবকটাকে একেবারে পিছনে ফেলে ঘণ্টায় ত্রিশ মাইল ছুটে সকলের মনে এমন তাক লাগিয়ে দিল যে, যারা ঝগড়া করতে এসেছিল তাদের আর কথাটি কইবার মুখ রইল না।
এমনি করে ১৮৩০ খৃষ্টাব্দে রীতিমত রেলের চলাচল আরম্ভ হল। তারপর কত ইঞ্জিন তৈরি হল, কত দিকে কত রেলের লাইন বসে গেল, গরীবের ছেলে স্টিফেনসন মস্ত ধনীলোক হয়ে গেলেন। কিন্তু জীবনের শেষ পর্যন্ত তাঁর সাধাসিধা চালচলন আর সহজ সরল ব্যবহারের কোন পরিবর্তন হয়নি। স্টিফেনসনের একমাত্র ছেলে রবার্টও কালে একজন নামজাদা ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিলেন; রেলের পোল তৈরির বিষয়ে তাঁর বিশেষরকম সুনাম ছিল।