মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ‌ই হবে বাজেটের মূল লক্ষ্য

গত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল সরকার৷ কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি৷ নতুন যে বাজেট পেশ হবে সেখানেও মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা।

গত এক বছরে মূল্যস্ফীতি গড়ে প্রায় ১০ শতাংশের মধ্যে ছিল৷ আর খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশেরও বেশি৷

সর্বশেষ মূল্যস্ফীতির যে হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো তাতে দেখা যায়, মে মাসে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৯.৮৯ শতাংশ৷ এপ্রিল মাসে এটা ছিল ৯.৭৪ শতাংশ৷ তবে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেশি বেড়েছে৷ এপ্রিলে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.২২ শতাংশ৷ মে মাসে হয়েছে ১০.৭৬ শতাংশ৷

আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হতে পারে ৬.৭৫ শতাংশ৷ চলতি (২০২৩-২৪) বাজেটে ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করে পরে সেটি কমিয়ে ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছিল৷ বাস্তবতা বিবেচনা করে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য থেকে সরে আসছে সরকার৷ তারপরও বড় ঘাটতি আর ভর্তুকির বাজেটই হচ্ছে৷

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতিই ভালো না৷ তার প্রতিফলন দেখা যায় মূল্যস্ফীতিতে৷ ব্যাংক ও আর্থিক খাত, রিজার্ভ, ডলারের দাম, বিনিয়োগ, বৈদেশিক ঋণ সব কিছুই নেতিবাচক৷ তাই সরকারকে উচ্চাভিলাষী বাজেট বাদ দিয়ে বাস্তবভিত্তিক বাজেট করতে হবে৷ প্রয়োজনে প্রবৃদ্ধির মাত্রা কম রেখে হলেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে৷ কারণ, এর প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর সবচেয়ে বেশি পড়ে৷

সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান  বলেন, ‘‘গরিবের তো আনন্দ৷ হাশরের দিন পাবে৷ এখন উপোস থাকলে ক্ষতি কী? এখানে গরিবের জন্য কিছু করা হয় না৷ যা করা হয় সব‌ই ধনীর জন্য৷”

এবারের বাজেটে সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাকেই মূল চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছে৷ তবে এই চ্যালেঞ্জে একটু ছাড় নিতে চায় সরকার৷ এবার মূল্যস্ফীতি শতকরা আট ভাগে রাখতে চায়৷ চলতি বাজেটে (২০২৩-২৪) ৬.৫ শতাংশে রাখার ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে এবার সেটা আট শতাংশ রাখা হচ্ছে৷

এটা করতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানো এবং বাজারে নন-ইকোনমিক ফ্যাক্টর নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া হবে৷ অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী নতুন বাজেটের বিষয়ে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখাই হবে আগামী বাজেটের মূল লক্ষ্য৷”

গত ১৩ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বাজেট নিয়ে বৈঠক করেছে অর্থবিভাগ৷ সেখানে তিনি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন৷ এবার বাজেটে (২০২৪-২৫) সার্বিকভাবে যা করা হচ্ছে তার টার্গেট হচ্ছে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা৷ অর্থমন্ত্রী বলেছেন তারা এবার কোনো উচ্চাভিলাষী বাজেট করছেন না৷ 

তাই বাজেটের আকার তেমন বাড়ছে না৷ বাজেট ঘাটতিও কমানো হবে৷ কিন্তু আয় বাড়ানোর জন্য বাড়বে করের বোঝা৷

জানা গেছে, নিত্য প্রয়োজনীয় ও নিত্য ব্যবহার্য অনেক পণ্যের ওপর কর বাড়তে পারে৷ তবে আয়কর বাড়ছে না৷ করমুক্ত আয়সীমাও গত বাজেটের মতো তিন লাখ টাকাই থাকছে৷ তবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে নির্ধারিত হারে কর দিয়ে৷

দেশের অর্থনীতি এখন নানা চাপে আছে৷ এরমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমা থামানো যাচ্ছে না৷ ডলারের দাম বাড়িয়ে অনেকটা বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ায় ঢাকার আরো অবমূল্যায়ন হয়েছে৷ রপ্তানি আয় নিয়ে সংকট আছে৷ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে না৷ বাড়ছে না কর্মসংস্থান৷ আর আর্থিক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনা যায়নি

অর্থমন্ত্রী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের যে বাজেট বৃহস্পতিবার সংসদে উপস্থাপন করবেন তার আকার হবে সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার৷ গত বাজেটের  চেয়ে এটা ৩৬ হাজার কোটি টাকা বেশি৷ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা৷

রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকা৷ এনবিআর কখনোই লক্ষ্যমাত্রার রাজস্ব আদায় করতে পারেনি৷ তারপরও এই রাজস্ব আদায় হলেও দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকবে৷ ঘাটতি পূরণে সরকার ঋণ নিতে চায় অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ও বৈদেশিক খাত থেকে৷

বাজেটে অর্থের জোগান দিতে সরকারকে এখন আগের চেয়ে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে৷ ফলে বাড়ছে ঋণ পরিশোধের চাপ৷ ডলার সংকট ও ডলারের বাড়তি দাম সরকারকে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে আরও বেশি চাপে ফেলেছে৷ আগামী অর্থবছরের জন্য সুদ পরিশোধে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা৷

অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম হলো ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’৷ সেজন্য তিনি দেশের অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় করতে চান দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা৷

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘আমরা সম্পদ আহরণের চ্যালেঞ্জে আছি৷ জিডিপি অনুসারে আমাদের রাজস্ব আদায় হলো উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন৷ এখন এটা বাড়াতে গিয়ে যদি পরোক্ষ কর (ভ্যাট) বাড়ানো হয় তাহলে তার চাপ তো সাধারণ মানুষের ওপর পড়বে৷ প্রত্যক্ষ কর (আয় কর), সেটা আদায় বাড়াতে হবে৷ ট্যাক্স নেট বাড়াতে হবে৷ এনবিআরকে দক্ষ করতে হবে৷”

‘‘বাজেটে ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণ এবং অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর নির্ভর করা হচ্ছে৷ ফলে এর চাপ দিন দিন বাড়ছে৷ বাজেটের একটা বড় অংশ আবার ওই খাতে ঋণ পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে৷ ফলে আমাদের সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া উপায় নেই,” বলেন তিনি৷

তার কথা, ‘‘দেশি বিদেশি দুই ধরনের বিনিয়োগই কমে যাচ্ছে৷ এর প্রভাব আবার পড়ে কর্মসংস্থানের ওপর৷ সুদের হার বেশি হওয়ায় শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যে এক ধরনের মন্দা৷ সরকার এটা কীভাবে মোকাবেলা করবে বাজেটে সেটা দেখার বিষয় আছে৷”

‘‘আর মূল্যস্ফীতিকে সবার ওপরে গুরুত্ব দিতে হবে৷ এটা কমিয়ে আনতে না পারলে সার্বিকভাবে পরিস্থিতি খারাপ থাকবে৷ এরজন্য প্রয়োজন হলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে এনে বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে,” বলে মনে করেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান৷

তার কথা, ‘‘অযথাই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়৷ এতে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হয়৷ আর এই সুযোগ দিয়ে কোনো লাভ হয়৷ খুব বেশি যে কালো টাকা সাদা হয় তাও নয়৷ আমরা মনে করি এটা অনৈতিক৷”

বাজেটকে সুশাসনের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন করা জরুরি বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ৷

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, ‘‘সার্বিকভাবে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাই চ্যালেঞ্জ৷ ব্যাংকিং সেক্টর, শেয়ারবাজার সবকিছু মিলে একটা অস্থিতিশীল অবস্থা চলছে৷ এর প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্যে৷ এগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য সর্বোপরি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে৷ এটা শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে সম্ভব নয়৷”

‘‘আর রিজার্ভের ওপর চাপ৷ ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় টাকার অবমূল্যায়ন৷ এগুলো ঠিক না রাখতে পাড়লে রপ্তানি বাড়বে না৷ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে৷ আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা দরকার,” বলেন তিনি।

তার কথা, ‘‘রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারলে হবে না৷ আর আমাদের খরচ কমাতে হবে৷ অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করতে হবে৷ এবারও দেখলাম এই খাতে অনেক বরাদ্দ রাখা হচ্ছে৷ সার্বিকভাবে সরকারকে একদম হিসাবনিকাশ করে একটি কমপ্যাক্ট বাজেট করতে হবে৷ এখানে উচ্চাভিলাষের কোনো জায়গা নেই৷ অভ্যন্তরীণ সম্পদ না বাড়িয়ে বাইরে থেকে ঋণ এনে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে না৷”

সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুল মান্নান বলেন, ‘‘আশা করি এবার বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর সুনির্দিষ্ট নীতি থাকবে৷ তবে এই পরিস্থিতিতে সরকার এক কোটি পরিবারকে যে খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে তা দেড় কোটি টাকা করা প্রয়োজন৷”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘কালো বলে কোনো টাকা নাই৷ সব আমার টাকা৷ ওই টাকা দেশে রাখতে হবে৷ সাবেক আইজিপি বেনজির সাহেব এয়ারপোর্ট থেকে চলে গেল৷ সে কি মাছি নাকি যে এয়ারপোর্ট থেকে চলে যাবে! গরিবের জন্য আইন, ধনীর জন্য কোনো আইন নাই৷”

‘‘দেশের গরিবদের অবস্থা খারাপ৷ গ্রামের গরিবদের অবস্থা আরো খারাপ৷ এটা ধনীদের লুটপাটের দেশ,” বলেন তিনি৷

সোর্সঃডিডব্লিউ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *