বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কাছেই মানিকগঞ্জের কিছু এলাকায় গত তিন মাসে বিষধর রাসেলস ভাইপার সাপের কামড়ে অন্তত পাঁচজন মারা গেছে বলে সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
রাসেলস ভাইপার সাপ বাংলাদেশে চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া নামেও পরিচিত।
বাংলাদেশে যেসব সাপ দেখা যায় সেগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বিষাক্ত বলে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন।
এর আগে ২০২১ সালে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি এলাকায়, পদ্মা তীরবর্তী কয়েকটি জেলা ও চরাঞ্চলে এই সাপের কামড়ে দুই জন নিহত ও কয়েকজন আহত হবার ঘটনা বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিলো।
কিন্তু গত কয়েক মাসে এই সাপের উপদ্রব দেখা যাচ্ছে ঢাকার একেবারে কাছে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চর এলাকাগুলোতে।
হরিরামপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শাহরিয়ার রহমান বলেন, “আমার উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের চরাঞ্চলে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে আহত হবার প্রকোপ বেশি দেখা যাচ্ছে। গত তিন মাসে মারা গেছে পাঁচজন।”
”এখন ধান কাটার মৌসুম চলছে। তাই আমরা কৃষকদের সচেতন করার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি কৃষকদের জন্য বিশেষ জুতার ব্যবস্থা করা যায় কি-না সেটি দেখা হচ্ছে।”
উপজেলার যে দুটি ইউনিয়নে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে বেশি আহত ও মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে তার একটি হলো আজিমনগর ইউনিয়ন। এর চেয়ারম্যান মোঃ বিল্লাল হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, এখন রাসেলস ভাইপারের আনাগোনা তারা বেশি দেখতে পাচ্ছেন।
“আমার ইউনিয়নেই মারা গেছে দুজন। গত বছরেও মারা গিয়েছিলো একজন।
আমরা মাইকিং করছি এলাকায়। ধান ও ভুট্টা ক্ষেত আছে যেগুলোতে ঝুঁকি বেশি। তবে এখন ধান কাটার মৌসুম হওয়ায় উদ্বেগটা বেশি,” বলছিলেন মি. হোসেন।
এই আজিমনগরেই সম্প্রতি আরও দুটি রাসেলস ভাইপার মেরে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। সবশেষ বৃহস্পতিবার চর এলাকায় নতুন করে রাসেলস ভাইপার দেখতে পান কৃষকরা।
এর আগে গত পহেলা মার্চ ভুট্টা ক্ষেতে পানি দেয়ার সময় রাসেলস ভাইপারের কামড়ে আহত হয়ে পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন লালমিয়া নামে একজন কৃষক।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসান বলেন, পদ্মার অববাহিকা ধরেই রাসেলস ভাইপার মানিকগঞ্জের চরাঞ্চলে গেছে।
মি. আহসান রাসেলস ভাইপারের পুনরাবির্ভাব ও এই সাপ থেকে মানুষের ঝুঁকির বিষয়ে গবেষণা করেছেন।
“২০১৩ সাল থেকে এই সাপটি বেশী দেখা যাচ্ছে। পদ্মার চরাঞ্চল থেকে শাখা ও উপনদী ধরে কচুরি পানার সাথে এগুলো পাশের এলাকাগুলোতে যাচ্ছে। মানিকগঞ্জের চরে সেভাবেই গেছে বলে মনে হচ্ছে,” বলছিলেন তিনি।
হরিরামপুরের লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের কাঞ্চনপুর ও ফরিদপুর সদর উপজেলার চরে সেলিমপুর এলাকায় সবশেষ সাপটি কৃষকদের দৃষ্টিতে এসেছে।
২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ২০টি রাসেলস ভাইপার দংশনের ঘটনা বিশ্লেষণ করে করা একটি গবেষণার ফল ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইাটি, বাংলাদেশে।
এছাড়া ২০১৪ ও ২০১৫ সালে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি চর এলাকায় বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করা অন্তত পাঁচটি রাসেলস ভাইপার সাপ অবমুক্ত করা হয়।
সেসময় ঐ গবেষণায় উঠে আসে যে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ১৭টি জেলাতেই রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতি রয়েছে। ঐ গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতেই এই সাপের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল।
তখন বলা হয়েছিলো যে এই প্রজাতির সাপের সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি ছিল রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়।
যদিও সাপের এই প্রজাতিটি বাংলাদেশ থেকে বহু বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু গত ১০-১২ বছর আগে থেকে আবারো এই সাপের কামড়ের ঘটনায় এগুলোকে আবার দেখা যাচ্ছে।
অধ্যাপক মোঃ ফরিদ আহসান অবশ্য বলেছেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় স্বল্প সংখ্যক রাসেলস ভাইপার সবসময়ই ছিল, কিন্তু বংশবিস্তারের মত পরিবেশ ও পর্যাপ্ত খাদ্য না থাকায় এই সাপের উপস্থিতি তেমন একটা বোঝা যায়নি।
এখন একই জমিতে বছরে একাধিক ফসলের ফলানোর কারণে এই সাপের সংখ্যা বাড়ছে কারণ বছর জুড়ে ক্ষেতে ফসল থাকায় ইঁদুরের সংখ্যা বাড়ছে।
“আর ইঁদুর বাড়ার সাথে সাথে সাপ পর্যাপ্ত খাদ্য পেতে শুরু করে এবং বংশবিস্তারের জন্য যথাযথ পরিবেশ পেতে থাকে,” বলছিলেন মি. আহসান।
ঘন ঝোপ আর পরিত্যক্ত জমি অপেক্ষাকৃত কমে যাওয়ায় এই সাপ কৃষি জমিতেই থাকে, যার ফলে যারা মাঠে কৃষিকাজ করেন তারা রাসেলস ভাইপারের দংশনের সবচেয়ে বেশি শিকার হয়ে থাকেন।
এছাড়া বর্ষাকালে নদীর পানি বাড়ার ফলে ভারতের নদ-নদী থেকে ভেসেও এই সাপ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে বলে জানান মি. আহসান।
সোর্সঃবিবিসি