পাঁচ বছর আগে ২০১৯ সালে ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় ২৭ জন মুসলিম এমপি নির্বাচিত হলেও, ২০২৪ সালে হয়েছেন মাত্র ২৪ জন। অর্থাৎ তিনজন এমপি কম।
সব দল মিলিয়ে ২০১৯ সালে যত মুসলিম প্রার্থী দাঁড় করানো হয়েছিল, ২০২৪-এ তার থেকে ৪১ জন কম মুসলিম প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
ভারতে এবারের লোকসভায় সংসদে বসবেন ২৪ জন মুসলিম এমপি। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক এমপি বসবেন প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের জন্য নির্ধারিত বেঞ্চে – ৭ জন।
এরপরেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলিম এমপি লোকসভায় পাঠিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস। পাঁচ জন।
উত্তরপ্রদেশের প্রধান বিরোধী দল সমাজবাদী পার্টি থেকে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে চার জন মুসলিম প্রার্থী। কেরালার দল ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ থেকে তিন ও কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্স থেকে দু‘জন, হায়দ্রাবাদের অল ইন্ডিয়া মজলিস-এ- ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের এমপির সংখ্যা এক এবং নির্দলীয় ২।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলিম এমপি লোকসভায় যাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে, যার মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের পাঁচ জন এবং কংগ্রেসের একজন।
ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স-এর (এনডিএ) একজন মুসলমান প্রার্থীও জেতেননি। বস্তুত, এনডিএ’র ২৯৩ জন এমপির মধ্যে মুসলিম, খ্রিস্টান বা শিখ সমাজের ধর্মীয় সংখ্যালঘু এমপি একজনও নেই। উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশ থেকে বিজেপির এক বৌদ্ধ এমপি এবারেও জিতেছেন।
বিজেপি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পরে লোকসভায় কখনোই মুসলিম জনপ্রতিনিধির সংখ্যা পাঁচ শতাংশের উপরে যায়নি। ভারতে মুসলিম জনপ্রতিনিধি, ১৯৫৭ এবং ১৯৯৯ সাল ছাড়া , প্রতিবারই ছিল ৫ শতাংশের উপরে। সর্বোচ্চ মুসলমান জনপ্রতিনিধি ছিল ১৯৮০তে, ৯.০৪ শতাংশ এবং ১৯৮৪ সালেও ছিল ৮ শতাংশের উপরে। এবারে তা নেমে এসেছে ৪.৪২ শতাংশে, যা ২০১৯এর থেকেও বেশ খানিকটা কম।
তবে মুসলিম এমপির সংখ্যা ২৭ থেকে মাত্র তিন কমে ২৪ হলেও, সব দলই বিরাট কম সংখ্যক মুসলিম প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে ২০২৪-এর নির্বাচনে। সম্ভবত অতীতে কখনোই এত কম সংখ্যক মুসলিম প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি।
দশ বছর আগে ২০১৪ সালে সব দল মিলিয়ে ৩২০ জন মুসলিম প্রার্থী ছিলেন, যা ২০১৯-এ নেমে আসে ১১৫ জনে। এবারে তা কমে হয়েছে ৭৮। অর্থাৎ প্রতি নির্বাচনে ভারতে মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যা দ্রুত হারে কমছে।
সম্ভবত তার চেয়েও লক্ষণীয় বিষয় হল, স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসে এই প্রথম কেন্দ্র সরকারে কোন মুসলমান মন্ত্রী নেই। এটা ২০১৪ এবং ২০১৯ সালেও হয়নি। দশ বছর আগে লোকসভায় মুসলমান এমপির সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম, মাত্র ২৩। অর্থাৎ এবারের চেয়েও এক কম। কিন্তু সেবারেও সংখ্যালঘু মন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন নাজমা হেপতুল্লা।
বিজেপি ২০১৯ সালে তিনশোরও বেশি আসন পায়, কিন্তু সেবারও একজন মুসলমান মন্ত্রী ছিলেন সংখ্যালঘু মন্ত্রকের দায়িত্বে – মুখতার আব্বাস নাখভি।
এর অর্থ, ২০২৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও, ভারতের রাজনীতির ‘প্লুরালিস্ট’ বা বহুত্ববাদী চরিত্র হারিয়ে হিন্দুসংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের কাঠামো প্রতি নির্বাচনেই যে শক্তপোক্ত হচ্ছে। উপরের পরিসংখ্যানই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
হিন্দুত্ববাদী দক্ষিণপন্থী দলের শক্তি কমুক বা বাড়ুক, বিজেপি-বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো এখন আরো কম সংখ্যক মুসলিম প্রার্থী দিচ্ছে।
তৃণমূল কংগ্রেস গতবারে দিয়েছিল ১৩, এবারে ৬, সমাজবাদী পার্টি দিয়েছিল ৮ এবং এবারে ৪। বিহারের রাষ্ট্রীয় জনতা দল গতবারে দিয়েছিল ৫ জনকে এবং এবারে মনোনয়ন দিয়েছে দুই মুসলিম প্রার্থীকে।
অর্থাৎ বিজেপি-বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিও প্রবল ভাবে মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যা কমাতে আরম্ভ করেছে।
কিন্তু কম প্রার্থী দিলেও, শতাংশের হারে মুসলিম প্রার্থী জিতেছে বেশি। এর কারণ ব্যাখ্যা করে কলকাতার প্রতীচি ইনস্টিটিউটের জাতীয় গবেষণা সমন্বয়ক এবং রাজনীতি বিশ্লেষক সাবির আহমেদ বলছিলেন, গত ১০ বছরের ‘ট্রেন্ড‘ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে বিজেপির আসন যত বাড়ছে, তত মুসলিম প্রতিনিধিত্ব লোকসভায় কমছে।
“এবারে,এনডিএ এবং প্রধানত বিজেপির আসন কমার ফলে, মুসলিম প্রতিনিধিত্ব বাড়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এবারে বিরোধীরা আগের বারের থেকে প্রার্থী অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিল। ফলে একটা চিন্তার জায়গা তৈরি হয় যে শেষ পর্যন্ত কতজন মুসলিম প্রার্থী পার্লামেন্টে যেতে পারবে। এবার যদি বিরোধীরা গতবারের বা অতীতের মতো মুসলিম প্রার্থী দিতেন, তবে মুসলিম প্রতিনিধিত্ব বাড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল বলে মনে হয়,” তিনি বলেন।
কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনীতি বিশ্লেষক মহম্মদ রিয়াজও মনে করেন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যা কমিয়ে দেওয়ার কারণেই লোকসভায় প্রতিনিধিত্ব আরো কমে গিয়েছে।
বিষয়টি আগামী দিনের ভারতের রাজনীতি সম্পর্কে কী ইঙ্গিত দেয় এই প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক রিয়াজ বলেন, “ভারতের রাজ্য বিধানসভা বা জাতীয় পার্লামেন্টে মুসলিমদের আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব (প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) কখনোই ছিল না। এর উপরে জোরালো হিন্দুত্ববাদী হওয়ার জেরে তারা আরও প্রান্তিক হয়েছে বা বলা যায় লোকসভা থেকে কার্যত অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।”
এর প্রধান কারণ হিসেবে বিজেপি-বিরোধী ‘সেকুলার‘ দলগুলিকেই দায়ী করলেন অধ্যাপক রিয়াজ।
“আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দল গুলি ধরেই নিয়েছে যে মুসলিম ভোট তারাই পাবে, এই ধরে নেওয়ার রাজনীতি মুসলিম জনপ্রতিনিধির সংখ্যা ক্রমাগত কমাচ্ছে। যে সমস্ত আসনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই সেখানে তাদের জেতার সম্ভাবনাও ক্রমশই কমছে।”
এটাকেই হিন্দুত্ববাদের সবচেয়ে বড় জয় বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা, যখন বিজেপি আসন কম পেলেও পরাজয়ের আশঙ্কায় ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যা দ্রুত কমিয়ে দিচ্ছে।
ভারতের লোকসভায় মুসলমান প্রতিনিধিত্ব ভবিষ্যতে আরো কমবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। সেই কারণেই, মুসলমান সম্প্রদায়ের বিষয় নিয়ে ভারতে যে ওয়েবসাইটটি নিয়মিত লেখালেখি করে সেই ‘মক্তব মিডিয়া’য় গত বছরে এক উপ-সম্পাদকীয়তে সমাজকর্মী ও সাংবাদিক শার্জিল ইমাম আনুপাতিক ভিত্তিতে মুসলমান জনপ্রতিনিধি ভারতের পার্লামেন্টে পাঠানোর পক্ষে বক্তব্য রেখেছিলেন।
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, আগামী দিনে যখন কেন্দ্রীয় স্তরে ভোটার সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নতুন করে নির্বাচনী কেন্দ্র ভাগ হবে (ডিলিমিটেশন) তখন মুসলমান প্রতিনিধিত্ব আরো কমবে।
দিল্লির এক গবেষক আসিফ মুজতবাকে উদ্ধৃত করে ‘মক্তব মিডিয়া’ই সম্প্রতি জানিয়েছে, এই মুহূর্তে যে আসনে মুসলমান জনসংখ্যা ও ভোটার বেশি রয়েছে, সেই আসন পরবর্তী সময়ে তফসিলি জাতি এবং উপজাতির জন্য সংরক্ষিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, এই ঘটনাটি সম্প্রতি ঘটেছে আসামে। ফলে, ভবিষ্যতে ভারতে বিজেপি হারতে বা জিততেও পারে, কিন্তু পার্লামেন্টে মুসলমান প্রতিনিধিত্ব যে কমবে তা নিয়ে বিশেষ সন্দেহ পর্যবেক্ষকদের নেই।
সোর্সঃভিওএ