যশোরের অভয়নগরে আফরোজা বেগম (৪০) নামে এক নারী পুলিশি নির্যাতনে মারা গেছেন বলে তার পরিবার অভিযোগ করেছে৷ আদালতে যেন মামলা করা না হয়, সেজন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ঐ নারীর বড় ছেলে৷
যে পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে সেই এএসআই সিলন আলী এবং যশোর জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জাহিদুল ইসলাম আফরোজা বেগমকে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন৷ জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘‘ঐ নারীকে নির্যাতনের কথা আমরা সংবাদমাধ্যমেই জানতে পারছি৷ বাস্তবে এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি৷ চিকিৎসকরা বলেছেন, তিনি কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মারা গেছেন৷ তারপরও আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি৷ অভিযোগ প্রমাণ হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘ওই নারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা না থাকলেও তার পরিবার মাদক ব্যবসায়ী৷”
আফরোজা বেগমের বড় ছেলে আরিফ হোসেন মুন্না জানান, ‘‘থানা মামলা নেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে৷ আর আমরা যাতে আদালতে মামলা না করি সেজন্য আমাদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে৷”
অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া এলাকায় বাস করা আফরোজা বেগমের স্বামীর নাম জলিল মোল্লা৷ তার দুই ছেলের মধ্যে একজন আরিফ হোসেন মুন্না ইজিবাইক চালান৷ আর সাব্বির হোসেন নবম শ্রেণির ছাত্র৷ আফরোজা বেগমের স্বামীও ইজিবাইক চালাতেন৷ অসুস্থতার কারণে এখন চালান না৷
মুন্না অভিযোগ করেন, ‘‘১ মে রাত ১২টার দিকে চার-পাঁচজন পুলিশ সদস্য আমাদের বাড়িতে যায়৷ তখন শুধু আমার ছোট ভাই ও মা বাড়িতে ছিলেন৷ আমি খবর পেয়ে বাড়িতে গিয়ে দেখি আমার মাকে আমাদের বাড়িতেই ফ্যানের সাথে তার চুল বেঁধে ঝুলিয়ে নির্যাতন করছে পুলিশ৷ আর আমার ছোট ভাই ভয়ে চিৎকার করছে৷ আমি যাওয়ার পর অনেক অনুরোধ করার পরও তারা নির্যাতন থামায়নি৷ তারা চুল বাঁধা অবস্থায় সিলিং ফ্যান চালিয়ে দেয়৷ তখন আমার মা ফ্যানের সঙ্গে ঘুরছিলেন৷ ওই অবস্থায়ই তারা আমার মাকে পেটাতে থাকে৷”
তখন আমাদের ঘরে আমার বাবার ইজিবাইক বিক্রির এক লাখ ৮৮ হাজার এবং গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া আমার ৫০ হাজার টাকা ছিল৷ ওই টাকা তারা নিয়ে যায়৷ এরপর আমার মাকে ছাড়ার জন্য আরো দুই লাখ টাকা ঘুস চায়৷ টাকা নেয়ার জন্যই স্থানীয় সন্ত্রাসী তরিক শেখকে সাথে নিয়ে পুলিশ আমাদের বাড়ি যায়,” বলে অভিযোগ করেন তিনি৷ মুন্নার অভিযোগ, ‘‘ওই টাকা নেওয়ার পর আরো দুই লাখ টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় এএসআই সিলন আলী তার পকেট থেকে ইয়াবা বের করে মামলার কথা বলে আমার মাকে রাত দুইটার দিকে থানায় নিয়ে যায়৷”
সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে রোববার সকালে অভয়নগর উপজেলা হাসপাতালে নেওয়া হয়৷ হাসপাতাল থেকে আবার থানায় আনা হলে থানার সামনেই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান বলে মুন্না জানান৷ এরপর আবার থানা থেকে যশোর সদর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পর দুপুর ১২টার দিকে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন৷ মুন্না অভিযোগ করেন, ‘‘নির্যাতনের পর রাতে থানায় আমার মাকে কোনো খাবার এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি৷ সকালে গিয়ে দেখি আমার মায়ের পুরো শরীর ফুলে গেছে৷ তিনি দাঁড়াতে পারছিলেন না৷ এরপর তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে চাইলেও ওই সকালেই পুলিশ তাকে আবার থানায় নিয়ে আসে৷ তখন পুলিশ সদস্যরা বলে তার চিকিৎসা কারাগারে হবে৷”
আফরোজার ছোট ছেলে সাব্বির হোসেন অভিযোগ করেন, ‘‘রাত ১২টার দিকে বাড়িতে ঢুকেই অভয়নগর থানার এএসআই সিলন আলী আম্মুকে বলে, তোর কাছে যা আছে বের করে দে৷ আম্মু তার কাছে কিছু নেই জানালে সিলন আলী একজন নারী পুলিশ দিয়ে তার দেহ তল্লাশি করেও কিছু পায়নি৷ এরপর সিলন আলী আম্মুকে বেধড়ক মারধর করলে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে৷ এরপর আমার সামনে আম্মুর চুল ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে ফ্যান ছেড়ে দেওয়া হয়৷”
মুন্না অভিযোগ করেন, ‘‘পুলিশের সঙ্গে আরো কয়েকজন লোক ছিল৷ তারমধ্যে স্থানীয় সন্ত্রাসী এবং একাধিক মামলার আসামি তরিক শেখও ছিল৷ আসলে আমাদের বাড়িতে টাকা থাকার খবর পেয়েই তারা আসে৷ ওই টাকা নেওয়ার পরও আরো দুই লাখ টাকা ঘুস না পেয়ে তারা আমার মাকে নির্যাতন চালায় এবং সাজানো মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়৷”
যার বিরুদ্ধে মারধর এবং ঘুস চাওয়ার অভিযোগ সেই এএসআই সিলন আলী অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘ওই পরিবারটি যে মাদক ব্যবসায়ী তা সবাই জানে৷ আমরা খবর পেয়ে তাদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তার কাছে ৩০ পিস ইয়াবা পাই৷ তাকে কোনো মারধর করা হয়নি৷ তার গায়ে একটি ফুলের টোকাও দেওয়া হয়নি৷ আমরা কয়েকজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে ইয়াবা জব্দ করি৷ দুইজন সাংবাদিক ভাইও সেখানে ছিলেন
ওই নারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিলো কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘না, আগে কোনো মামলা ছিল না৷ তবে ইয়াবা উদ্ধারের পর আমরা মাদক আইনে মামলা করেছি৷”
সিলন আলী দাবি করেন, ‘‘ম্যাজিষ্ট্রেটের উপস্থিতিতে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট হয়েছে৷ তারা তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাননি৷”
তিনি দাবি করেন, তারা সঙ্গে কোনো লোকজন নিয়ে জাননি, যারা ছিলেন তারা আশেপাশের লোক৷ আর দুই সাংবাদিকের নাম জানতে চাইলে সিলন আলী তা বলতে পারেননি৷
তবে মুন্না বলেন, ‘‘আমাদের বাড়িটি নির্জন এলাকায়৷ পাশে একটি বাড়ি আছে৷ নির্যাতনের সময় তারা আমাদের বাড়িতে গেলে তাদের ভয় দেখিয়ে বের করে দেওয়া হয়৷ যাদের কথা পুলিশ বলছে তাদের তারা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল৷”
যশোর জেনারেল হাসপাতালে লাশের ময়নাতদন্তের পর আফরোজার লাশ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয় মঙ্গলবার৷ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক হাসিব মোহাম্মদ আলী জানিয়েছেন, ‘‘হাসপাতালে আনার আগে পথেই ওই নারীর মৃত্যু হয়েছে৷ ময়নাতদন্ত হয়েছে৷ সেটা আমরা থানায় পাঠিয়ে দেব৷” তিনি মৃত্যুর কারণ প্রকাশ করতে অপারগতা জানান৷
তবে অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আকিকুল ইসলাম দাবি করেন, ‘‘ময়নাতদন্তে তার মৃত্যু হার্ট অ্যাটাকে হয়েছে বলে জানানো হয়েছে৷” নির্যাতন ও ঘুস দাবির অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি৷
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক) এক বিবৃতিতে বলেছে, আফরোজার পরিবার যে অভিযোগ করেছে তা গুরুতর৷ পুলিশ হেফাজতে থাকা ব্যক্তিকে শারীরিক নির্যাতন করা বেআইনি এবং অপেশাদার আচরণ৷ আর মধ্যরাতে একজন নারীকে আটক করতে যাওয়া অগ্রহণযোগ্য৷ তার পরিবারের কাছে ঘুস চাওয়ার অভিযোগ এখন পুলিশের বিরুদ্ধে একটি নিয়মিত অভিযোগ।
আসকের সভাপতি অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন, ‘‘এটা একটা মগের মুল্লুকও না, বর্বর শাসনে পরিণত হয়েছে৷ হেফাজতে নির্যাতন ও হত্যার বিরুদ্ধে আইন থাকলেও এখানে মামলা করা যায় না৷ কোনো প্রতিকার বা বিচার পাওয়া যায় না৷ পাওয়া তো দূরের কথা বিচার চাওয়াও যায় না৷”
তার কথা, ‘‘এটাই একমাত্র ঘটনা নয়৷ এরকম ঘটনা আরো ঘটছে৷ চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক ভ্যান চালককে মাদক ব্যবসায়ী বলে মেরে ফেলা হয়েছে৷ আসল মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখি না৷”
‘‘কী এমন হয়েছে যে, একজন নারীকে মধ্যরাতে গ্রেপ্তার করতে যেতে হবে? এমনিতেই রাতে কোনো বাড়িতে অভিযানের ব্যাপাারে কিছু নিয়ম নীতি আছে৷ তারপর তারা একজন নারীকে গ্রেপ্তার করতে গেছেন৷ এরমধ্যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য যে আছে, তা সহজেই বোঝা যায়,” বলেন অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না৷
আসকের হিসাবে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে পুলিশ হেফাজতে সারাদেশে চার জনের মৃত্যু হয়েছে৷ এই সময়ে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৩৯ জন৷ আর ২০২৩ সালে পুলিশ ও র্যাবের হেফাজতে মারা গেছেন ২০ জন৷ ওই সময়ে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ১০৬ জন৷
সোর্সঃডিডব্লিউ