আম নিয়ে চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদের মতামত

আম যে শুধুমাত্র স্বাদের জন্য অনন্য, তা নয়। এই ফলটি বিশেষ পুষ্টিগুণেও সমৃদ্ধ। কিন্তু পুষ্টিগুণ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই আছেন, যারা আম খেতে পারেন না।

আমে প্রাকৃতিকভাবেই চিনির পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। তাই এটি খেলে মানুষের শরীরের স্যুগারের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।

এ কারণে অনেকে বলে থাকেন, ডায়াবেটিস রোগীদের আম খাওয়া উচিৎ না। কিন্তু আম কি আসলেই ডায়াবেটিসের মাত্রা বৃদ্ধির কারণ? ডায়াবেটিসের রোগীরা কি কখনও আম খেতে পারবেন না? যদি পারেন, সেটি কখন?

বাংলাদেশে এপ্রিল মাস থেকেই কাঁচা আম পাওয়া যায়। তবে পাকা আম আসতে শুরু করে মে মাস থেকে। জুলাই বা অগাস্ট পর্যন্ত দেশীয় আম পাওয়া যায়।

পুষ্টিবিদ সামিয়া তাসনিম বলেন, পাকা আমে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি, শর্করা, আমিষ, ভিটামিন এ, বিটা ক্যারটিন, পটাশিয়াম ইত্যাদি থাকে।তাই, কাঁচা আমের তুলনায় আঁশযুক্ত পাকা আম শরীরের জন্য বেশি ভালো।পাকা আমে পর্যাপ্ত পরিমাণ আঁশ জাতীয় উপাদান পেকটিন থাকে, যা পাকস্থলিতে থাকা খাদ্যকে ভালোভাবে পরিপাক হতে সাহায্য করে।

আমে থাকা ভিটামিন সি, ভিটামিন এ ও অন্যান্য ২৫ ধরনের ক্যারোটেনয়েডস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। বিশেষ করে, আমে থাকা ভিটামিন এ দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে ও চোখের চারপাশের শুষ্কভাবও দূর করে।

আমে প্রচুর বিচাক্যরটিন থাকায় এবং ভিটামিন এ , ই থাকায় আমাদের স্কিন খুব ভালো রাখে এবং এটি খেলে চোখের দৃষ্টি শক্তিও ভালো থাকে।ক্যান্সার প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে আম। কৃষি তথ্য সার্ভিসের বর্ণনা অনুযায়ী, পাকা আমে যেহেতু কাঁচা আমের তুলনায় শর্করার পরিমাণ বেশি, তাই কাঁচা আম দেহের শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। লিভারের সমস্যায় কাঁচা আম উপকারী। এটি বাইল এসিড নিঃসরণ বাড়ায়। অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াকে পরিষ্কার করে। দেহে নতুন রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে।

সবমিলিয়ে, আমে থাকা নানা ধরনের পুষ্টি উপাদানের জন্য এটি উপরে উল্লিখিত বিষয়ের বাইরেও খসখসে চামড়া, চুলপড়া, হজমের সমস্যা দূর করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

একাধারে অতুলনীয় স্বাদ ও একাধিক পুষ্টিগুণের কারণেই একে ফলের রাজা বলা হয়।

পুষ্টিবিদ তাসনিম বলেন, একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ অনায়াসেই দৈনিক দু’টো আম খেতে পারেন।সেক্ষেত্রে, ফজলি আম খাওয়াটা বেশি ভালো বলে জানান তিনি। কারণ ফজলি আমে ভিটামিন এ, পটাশিয়াম, বিটা ক্যারোটিনের পরিমাণ অনেক।তবে যারা কিডনি বা ডায়াবেটিসের রোগী, আম খাওয়ার ক্ষেত্রে তাদেরকে সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দেন তিনি।তিনি জানান, কিডনি রোগীদের ডাক্তার ও পুষ্টিবদের সাথে পরামর্শ করে আম খাওয়া উচিৎ। কারণ আমে প্রচুর পটাশিয়াম থাকে, যা কিডনির জন্য ক্ষতিকর।

যুক্তরাজ্যে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস-এর প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯ থেকে ৬৪ বছরের পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ৪০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি প্রয়োজন।তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত খাদ্যতালিকায় এটি ৬০ মিলিগ্রাম।এখন, যেহেতু এক কাপ আমে প্রায় ৬০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি থাকে, সেহেতু অন্য কোনও জটিলতা না থাকলে একজন সুস্থ মানুষ ওই পরিমাণ আম খেতেই পারেন।

অতিরিক্ত আম খেলে মানুষ মোটা হয়? তাসনিম জানান, প্রতি ১০০ গ্রাম আমে ৭৯ থেকে ৮২ গ্রাম ক্যালরি পাওয়া যায় এছাড়া, একটি আমের ৭৫ থেকে ৮৫ শতাংশ পানি থাকে। তবে মজার বিষয় হলো, আমে কোনও ‘কোলেস্টেরল’ থাকে না। এমনকি এতে ক্ষতিকর লবণও নেই।তারপরও অনেকেই মোটা হয়ে যাওয়ার ভয়ে আম খেতে চান না।“আমে কোলেস্টেরল কম থাকলেও এতে শর্করা বেশি থাকায় এবং অন্যান্য খাবারের বাড়তি ক্যালরির জন্য এটি পরবর্তীতে আমাদের শরীরে গিয়ে শর্করা ই ফ্যাট হিসেবে জমা হয়,” বলেন পুষ্টিবিদ সামিয়া তাসনিম।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, “আমে যেহেতু ক্যালরি অনেক, তাই বেশি আম খেলে ওজন বেড়ে যাবে।”“সেজন্য যার ওজন বেশি থাকবে, সে আরও কম আম খাবে। আর কেউ আম না হয় খেল, কিন্তু আম খেলে সে অন্য কিছু খাবে না। তাহলেই তো হলো,” তিনি যোগ করেন।“সকালে বা দুপুরে আম খেল, তার পরিবর্তে ভাত খেল না। তাহলে তো মোটা হবে না।”

অনেকেই বলে থাকেন, ডায়াবেটিস রোগীরা আম খেতে পারবেন না। যদিও এ বিষয়ে গবেষণার ফলাফল এবং চিকিৎসকদের বক্তব্য ভিন্ন কথা বলছে।

২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘ম্যাংগো অ্যান্ড ডায়াবেটিস’ শীর্ষক এক গবেষণাপত্রে দেখা গেছে যে ডায়াবেটিস রোগীদের আম খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ না।তবে তাদেরকে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আম খেতে হবে।

এই গবেষণায় বলা হয়েছে, যদি সতর্কতার সাথে আম খাওয়া হয়, তাহলে ডায়াবেটিসের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে না। তবে একসাথে অনেকখানি না খেয়ে অল্প আম খাওয়া উচিৎ। যেমন, একজন ডায়াবেটিক রোগী দৈনিক ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম আম খেতে পারেন। অথবা, দিনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তিনি ৫০ গ্রাম করে তিনবারও আম খেতে পারেন।

তবে খাবার খাওয়ার পর এমনিতেও একজন মানুষের রক্তে স্যুগারের পরিমাণ কিছুটা বেশি থাকে। সেখানে আম খেলে এটি আরও বেশি পরিমাণে বাড়বে। সেইসাথে, অন্যান্য শর্করার সাথে আম বেশি খেলেও ডায়াবেটিস বাড়তে পারে।এ বিষয়ে মিজ তাসনিম পরামর্শ দেন, “দুই বেলার মেইন খাবার খাওয়ার পরে আম খাওয়া ভালো। অথবা, খাওয়ার অন্তত দুই ঘণ্টা পর আম খাওয়া উচিৎ।”

সুতরাং, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চললে কোনোপ্রকার সমস্যা ছাড়াই ডায়াবেটিস রোগীরা পরিমিত পরিমাণ আম খেতে পারবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *